মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০১৭

৫০০ টাকায় ঘুরে আসুন নাপিত্তাছড়া

যারা নাপিত্তাছড়া ট্রেইলে গিয়েছেন তাদের কিছু বলার নেই কিন্তু যারা যাইনি তারা আমার এই পোস্টটা একবার হলেও পড়বেন। আশা করবো আপনাদের নাপিত্তাছড়া ঘুরে আসতে কোন প্রব্লেম হবে না।
আমরা চিটাগাং এর উপর দিয়ে বান্দরবান, কক্সবাজার, রাঙামাটি,, খাগড়াছড়ি প্রায় যাই কিন্তু আমাদের সবার কাছেই অজানা রয়ে গেলো সীতাকুণ্ড এবং মিররসরাই এর ঝরনাধারা/ ঝিরিপথগুলো। কতটা সুন্দর এই ঝরনাগুলো এবং ঝিরিপথ গুলো যারা গিয়েছে শুধুমাত্র তারাই বুঝবে।

চিটাগাং ঘুরতে আসলে আমরা সাধারণত পতেঙ্গা, ফয়েসলেক এগুলাই ঘুরে চলে যাই। অনেকে হয়তো সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক ঘুরে যায়। এগুলোতে মেয়েরাও ঘুরতে পারে কিন্তু আমরা যারা এডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ তারা অনেকেই জানি না সীতাকুণ্ড এবং মিররসরাই এতোগুলো ঝরনাধারা আছে। আমরা ট্র্যাকিং করার জন্য বান্দরবন চলে যাই। যদিও কয়েকবছর ধরে সীতাকুণ্ড এবং মিররসরাই আলোচনায় চলে এসেছে। এখন অনেকেই যাচ্ছে।
আমার ঘুরাঘুরিতে একটু আগ্রহ বেশি। তবে পরিবারের পারমিশন এবং টাকার জন্য চাইলেও কোথাও যেতে পারিনা। তাই যখনি টাকা থাকে তখনি ঘুরতে বের হয়ে যাই। চিটাগাং যাবার প্ল্যান অনেক দিন ধরেই করতেছিলাম কিন্তু যাবো যাবো বলে যাওয়া হচ্ছিল না।
১১/০৭/১৭ ইং তারিখ রাত ১০ টাই হঠাত চিটাগাং এর কয়েকজন ফ্রেন্ডের সাথে কথা বললাম যাবে কিনা নাপিত্তাছড়া। তারা রাজি আমিও রাজি। ১২ তারিখ সকাল ৫টাই বের হয়ে গেলাম নাপিত্তাছড়া ট্রেইলের দিকে। আমি যাত্রা শুরু করি লাকসাম, কুমিল্লা থেকে। সকালে রিক্সা না পাওয়ার কারনে ৩ কিলোমিটার হেঁটে তারপর সিএনজি করে লাকসাম জংশন যেতে হয়েছে। যাবার ৫ মিনিট আগে ডেমো ট্রেনটা চলে যায়। ট্রেন মিস করা যে কতটা কষ্টকর/বিরক্তিকর এটা শুধু তারাই বুঝবে যারা মিস করেছে। তারপর ১ ঘন্টা বসে রইলাম মেঘনা ট্রেনের জন্য। মেঘনা ট্রেন লাকসাম থেকে ছেড়ে গেলো ৭টা ৫ এ।
৮টার আগেই ফেনী চলে আসলাম। যেহেতু আমি নাপিত্তাছড়া ট্রেইলে যাবো তাই আমি ফেনী নেমে গেলাম কারন এতে আমার সময় বাঁচবে। ফেনী স্টেশন থেকে টমট্ম করে মহিপাল তারপর গ্রামবাংলা বাসে উঠে নয়দুয়ারি বাজারে গেলাম ৯ টায়। একজন ফ্রেন্ড আসতে দেরি হওয়াতে আমাদের ট্র্যাকিং শুরু হয় ১২ঃ৩০ থেকে। ৩ ঘন্টার বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে ওই ফ্রেন্ডের জন্য।
নাপিত্তাছড়া ট্রেইল শেষ করে আসতে আমাদের সময় লাগে প্রায় ৬ ঘন্টা। নরমারলি ৩ ঘন্টার বেশি লাগার কথা না। আমাদের দেরি হবার কারণ হচ্ছে বৃষ্টি এবং তার সাথে গাইড ছিল না তাই আমরা কয়েকবার ভুল পথে চলে গিয়েছিলাম। আরেকটা কারণ রয়েছে আমরা অনেক ছবি তুলেছি।
আমি ১২ তারিখ শুধু নাপিত্তাছড়া ঘুরেছি। ১৩ তারিখ বাঁশবাড়িয়া এবং কমলদহ ট্রেইল ঘুরেছি।
ঢাকা থেকে অনেক কম টাকাতে ঘুরে আসতে পারেন নাপিত্তাছড়া ট্রেইল। ডেটিং, রেস্টুরেন্টে বা মুভি দেখতেই আপনার ৫০০ টাকা লেগে যাচ্ছে। কিন্তু ভাবুন ওই টাকা দিয়ে আমি চিটাগাং ঘুরে আসতে পারবেন। অদ্ভুত হলেও সত্য। :3
যেভাবে যাবেনঃ
১. চিটাগাং মেইল ট্রেন কমলাপুর থেকে ১০ঃ৩০ এ ছেড়ে যায়। তাই চেষ্টা করবেন আগে যেতে। কারণ এটা লোকাল ট্রেন সিট নাও পেতে পারেন। ভাড়া ৯০ টাকা।
২. ফেনী পোঁছে যাবেন সকাল ৬ টার আগেই। ইচ্ছে করলে ষ্টেশনে অপেক্ষা করতে পারেন কারণ ৬ঃ৪০ এর দিকে ডেমো ট্রেন আছে ওইটা দিয়ে মিররসরাই যেতে পারবেন (ভাড়া ২০টাকা)। ডেমো ট্রেন দিয়ে গেলে মিররসরাই নেমে লেগুনা দিয়ে নয়দুয়ারি বাজারে আসবেন (ভাড়া ৫টাকা)।
অতবা,
স্টেশন থেকে টমটমে মহিপাল (ভাড়া ১০টাকা) এবং সেখান থেকে চিটাগাং গামী যেকোন বাসে উঠে যাবেন। অবশ্যই দামাদামি করে নিবেন। লোকাল বাস গুলা ৫০ টাকা নিবে এবং ভালোগুলা ১০০ নিতে পারে। বাসের কন্টাকডারকে বলবেন নয়দুয়ারি বাজারে নামিয়ে দিতে। যদি কোন ভাবে কন্টাকডার নয়দুয়ারি না চিনে তাহলে আপনার মোবাইলের জিপিএস ব্যাবহার করে সহজেই নয়দুয়ারি বাজার নেমে যেতে পারবেন। যেটা আমি করেছিলাম।
৩. নয়দুয়ারি বাজার থেকে দেখবেন পাহাড়ের দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে। ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করবেন। গাইড নেয়ার দরকার নেই। নিজেরাই পারবেন। কোন প্রকার সন্দেহ থাকলে ওখানকার মানুষদের জিজ্ঞেস করে নিবেন। ( ১ নাম্বার ছবিটা দেখুন)
৪. কিছুক্ষন হাঁটলে রেললাইন পেয়ে যাবেন। ওইট ক্রস করে একটু হাঁটলে ঝিরি পথ পাবেন। তারপর ঝিরি দিয়ে হাঁটা শুরু করুন। ২০ মিনিট হাঁটলে একটা ক্যাসকেড পাবেন। ২ নাম্বার ছবিটা হচ্ছে প্রথম ক্যাসকেড। ওইটা পাশে দিয়ে উপরে উঠে পুড়ুন। এবং দেখবেন আরেকটি ঝরনা যেটাকে কুপিটাকুম ঝরনা বলা হয়(৩ নাম্বার ছবিটা দেখুন)। এগুলাকে একেকজন একেকনামে চিনে।
৫. প্রথম ক্যাসকেডের উপর উঠার পর দেখবেন হাতের ডান পাশে পাহাড়ে উঠার একটা রাস্তা রয়েছে। ওই রাস্তা দিয়ে উপরে উঠার পর দেখবেন আবার ঝিরিপথ।
৬. ঝিরিপথ দিয়ে সামনের দিকে গেলে দেখবেন ঝিরিপথ দুইটা ভাগ হয়ে গেছে। হাতের বাম পাশে গেলে বাঘবিয়ানি ঝরনা পাবেন এবং ডানে গেলে বান্দরখুম/মিঠাইছড়ি ঝরনা পাবেন। আবার মাঝামাঝি তাকালে দেখবেন পাহাড়ের উপর উঠে গেছে আরেকটি রাস্তা। ওইটা দিয়ে যাবার কোন দরকার নেই। আমরা ওইটা দিয়ে গিয়ে আমাদের ১ ঘন্টা সময় নষ্ট করেছি সাথে এনার্জি।
৭. যদি ডানে যান তাহলে বান্দরখুম/মিঠাইছড়ি ঝরনা পাবেন (৪ নাম্বার ছবিটা দেখুন)। ওইটা দেখে আবার ৬ নাম্বারে চলে আসুন।
৮. ৬ নাম্বার থেকে বামে যান। একটু সামনে গেলে মনে হতে পারে সামনে যাবার কোন রাস্তা নেই। বড় বড় পাথর এবং গাছ পড়ে আছে। অবশ্যই রাস্তা রয়েছে। খুঁজে বের করুন। তারপর পেয়ে যাবেন বাঘবিয়ানি ঝরনা। (৫ নাম্বার ছবি দেখুন)
বাঘবিয়ানি ঝরনা দেখে আবার সেই একি পথে ফিরে আসুন নয়দুয়ারি বাজারে। হাতে সময় থাকলে বাঁশবাড়িয়া, মহামায়া লেক বা ইকোপার্ক ঘুরে আসতে পারেন। আমার মতে বাঁশবাড়িয়া সী বীচ যাওয়াটাই ভালো হবে কারণ বিকালে সমুদ্র দেখা যে অন্য রকম একটা অনুভূতি হয়।
যেখানেই যান না কেনো ওইখান থেকে মেইন রোডের আসুন তারপর যেকোন লোকাল বাস ধরে ফেনী চলে আসুন। চিটাগাং মেইল ট্রেনটি চিটাগাং ছেড়ে আসে ১০ঃ৩০ এ। হাতে সময় থাকলে চিটাগাং ষ্টেশনে চলে যান তারপর চিটাগাং মেইল ট্রেন ধরে ঢাকা চলে আসুন। আর যদি ফেনী চলে যান তাহলে অপেক্ষা করুন চিটাগাং মেইল ট্রেন আসার জন্য।
খরচঃ
১.আপনি যদি ঢাকায় থাকেন তাহলে ধরে নিলাম আপনার বাসা থেকে কমলাপুর ষ্টেশন যেতে বাস ভাড়া ২০ টাকা নিবে। আমি ধানমন্ডি থেকে বাসে ১০ টাকা দিয়ে যাই।
২. চিটাগাং মেইল ট্রেনের টিকেট=৯০ টাকা
৩. ফেনী থেকে টমটমে মহিপাল= ১০ টাকা।
৪. মহিপাল থেকে বাসে মিররসরাই নয়দুয়ারি বাজার ৫০ টাকা নিবে।
(যদি ফেনী থেকে ডেমো দিয়ে যান তাহলে মহিপাল না গিয়ে ষ্টেশনে অপেক্ষা করুন। ৭ টার ভিতর ডেমো ট্রেন চলে আসবে ওইটা দিয়ে মিররসরাই নেমে যান। ভাড়া ২০ টাকা নিবে। মিররসরাই নেমে লেগুনা/টেম্পু দিয়ে নয়দুয়ারি চলে যান। ভাড়া ৫ টাকা)
৫. খাওয়াদাওয়া নিজের উপর। আপনি কিভাবে খাবেন। রাজকীয় ভাবে খেলে টাকা বেশি লাগবে।
বিশেষ বিশেষ সতর্কতা:
১. আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করবেন না। সৌন্দর্য দেখার অধিকার আপনার আছে, নষ্ট করার অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নি। আপনার ফেলে আসা চিপস বা চানাচুরের প্যাকেট যথাস্থানে ফেলার কাজটি আপনাকেই করতে হবে।
২. হাঁটা শুরু করার আগে অবশ্যই আপনার সাথে করে আনা ভালো গ্রিপের জুতো বা হাইকিং স্যান্ডেল পড়ে নিবেন।
(যদিও আমার টিমের ৩ জন মেম্বারের পায়ে কোন জুতা ছিল না। জুতা না থাকলে হাঁটতে প্রব্লেম হবে। আমার পায়ে এমন একজুড়ো জুতা ছিল যেটা দিয়ে কিছুদিন আগে সাঁকোতে হাঁটতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম কিন্তু ভাগ্যক্রমে নাপিত্তাছড়া বা কমলদহ ট্রেইলে কিছু হয়নি আমার।)
৩. টিম মেম্বার সিলেক্ট করার সময় ভালো করে সিলেক্ট করবেন। এমন মেম্বার সিলেক্ট করবেন না যারা মাঝপথে গিয়ে টায়ার্ড হয়ে যাবে বা বলবে আর সামনে যাবে না এবং সেলফি রোগীদের নিবেন না সাথে। ওরা আপনার ট্রিপটাই নষ্ট করে দিবে।
৪. চাইলে গাইড নিতে পারেন। (আমরা ৪ জন যাদের বয়স ১৮-২০ এর মধ্যে তারাই নাপিত্তাছড়া এবং কমলদহ ট্রেইল ঘুরে এসেছি কোন গাইড ছাড়া।) আর আমি যেভাবে বলেছি এভাবে গেলে কোন গাইড দরকার নেই।
৫. নেটওয়ার্ক পাবেন না তাই যা ইনফরমেশন দরকার সেগুলোর স্ক্রিনশট নিয়ে রাখুন। চাইলে আমার পোস্টটাও নিতে পারেন। কাজে দিবে আমি গ্যারান্টি দিতে পারি।
৬. বৃষ্টির মধ্যে ডিএসএলআর ক্যামেরা নেয়া থেকে বিরত থাকবেন। এবং সাথে অবশ্যই পলিথিন রাখবেন মোবাইল বাঁচানোর জন্য।
৭. মেয়ে নেয়ার থেকে বিরত থাকবেন।
নাপিত্তাছড়া ট্রেইল নিয়ে আমার ভিডিও দেখতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
https://www.youtube.com/watch?v=jzbmAyirJfY
আশা করবো এই পোস্টটা আপনাদের কাজে দিবে এবং আপনাদের কোন কিছু জানার থাকলে আমাকে নক দিতে পারেন। এবং যেকোন প্রকার পরামর্শ দিতে পারেন আমাকে। আমি কৃতজ্ঞ থাকবো।

 লেখকঃMohaimin Al Mohid

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন